মেছো ভুতের নাম তো শুনেছেন, এ কিন্তু গেছো ভুত - Benami Diary

Thursday, June 25, 2020

মেছো ভুতের নাম তো শুনেছেন, এ কিন্তু গেছো ভুত

ভুতের গল্প আমরা অনেক শুনেছি। উঁচু উঁচু গাছে তেনারা বসে হওয়ায় পা দোলান। আর ইচ্ছে হলেই কারোর ঘাড় মটকে সাবাড় করে দেন। কিন্তু গাছের ভুত কোনো কালে কেউ শুনেছেন? হলফ করে বলতে পারি গাছে ভুত থাকার কথা শুনলেও, গাছের ভুত হওয়ার কথা হয়ত কেউ শোনেননি। কিন্তু সেটাও হয়। হয় মানে চাক্ষুস দেখেছি সে ভুত লোকের ওপর চড়তে। আমি বাপু গ্রামের মানুষ। আজকের ভাষায় জঙ্গল মহলের মানুষ। যে যাই মহল হোক গ্রামের আশেপাশে ছোট বেলায় প্রচুর জঙ্গল দেখেছি। আবার এক সময় রাত দিন কেটে সেই জঙ্গল সাবাড় করতেও দেখেছি মানুষকে। বড় বড় ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি এসব গাছ রাতারাতি উধাও হতেও দেখেছি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা কে কতটা খেতে পারে সেসময় তার এক প্রতিযোগিতা চলেছে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে সেই গাছ কাটার মিল থাকলেও এই ভুতের উৎপত্তি কোথায় সে কথা বলতে পারিনা হলফ করে।

ভদ্র লোকের বয়স ৬২ বা ৬৩ হবে। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন কুলটিকরি এসসি হাইস্কুলের। কিন্তু বাড়ি বাঁকুড়া জেলার সারেঙ্গাতে। অবসরের পর নিজের কর্মস্থলেই থেকে গেলেন। আর আতান্তরে পড়লেন ভদ্রলোকের স্ত্রী। কারন? কারন আর কিস্যু না, লোকের মদ বিড়ির নেশা হয়, আর এই মানুষটাকে কিনা পেল গাছ লাগানোর নেশা। সকাল নেই বিকেল নেই যখন তখন চললেন গাছ লাগাতে। কখনও বা শ্মশানে, কখনও পুকুর পাড়ে। গাছ লাগানো চলতেই থাকল। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া এ আর অন্য কি? শুধু কি লাগানো, লাগিয়ে রোজ জল দেওয়া, সার দেওয়া পরিচর্যা করা সবই চলতে থাকল নিয়মিত। একজন তথাকথিত বহিরাগত কিনা লেগে আছেন একটা এলাকায় গাছ লাগাতে। লোকে দেখে অভ্যস্ত মাস্টার মানুষ অবসরের পর পায়ের উপর পা তুলে খেতে। আর এ কিনা পেনশনের টাকায় চারিদিকে গাছ লাগিয়ে বেড়াচ্ছে।

তবে গাছ লাগানো শুধু আটকে নেই এখানে ওখানেই। অবশেষে একটা পতিত মোরাম পাথর ভর্তি জায়গা ঘিরে নিয়ে শুরু হল বৃক্ষরোপন। শুরু করলেন একটা নতুন রকম কাজ। কুলটিকরি মডেল অফ অ্যাফরেস্টেশন। অর্থাৎ ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগানো। এবার আর শুধু এক নন। এলাকার বেশ কিছু যুবক এগিয়ে এল মাস্টারের সাহায্যে। শাল, মহুল, বট, অস্বত্থ, বকুল, কাজু বাদাম ইত্যাদি বহুবর্ষজীবী গাছ। আর শুরু হল যেকোনো কাজ উপলক্ষে একটা গাছ লাগানো। কারোর জন্মদিন, বাবা বা অন্য কেউ একটা গাছ লাগালেন। কেউ মারা গেছেন তাঁর স্মৃতিতে একটা গাছ লাগানো হল। কারোর বা বিয়ে সে উপলক্ষ্যেও গাছ লাগিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। কেউ বা নেহাত শখের বসেই লাগিয়েছেন গাছ।আর তারপর সেই সব গাছের চারিদিকে বেড়া দেওয়া, গাছের যত্ন আত্তি করা সেসব দায়িত্ব মাস্টার এবং তাঁর টিমের। এলাকার বেশ কিছু আদিবাসী যুবক এগিয়ে এসেছেন স্যারের সাহায্যে। তাঁরা আশেপাশের গাছের লক্ষ্য রাখা থেকে শুরু করে গাছের পরিচর্যা সবটাই করেন সামান্য অর্থের বিনিময়ে। কখনও বা স্যার নিজের তাকে ছেলে মেয়েদের খেলার বল বা সামান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি জোগাড় করে দেন।

গৌরসাধনবাবু ও তাঁর টিম

একদম শেষ জায়গায় এসে ভদ্রলোকের নাম বলব। গৌরসাধন দাশচক্রবর্তী। মানুষটা এতটাই প্রচারবিমুখ যে নিজে পরিবেশদিবসের ছোট্ট অনুষ্ঠানে পর্যন্ত একবার মঞ্চে ওঠেন না বা মাইক হাতে নেন না। তাঁর নিজের কথায় মোটেই তিনি বিশেষ কোনো কাজ করছেন না। অবসর জীবনে অন্তত সাধারণ মানুষের জন্য একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ব্যবস্থা করছেন মাত্র। সকাল হোক বা বিকেল ওই খাটো ভদ্রলোককে একটা সাইকেল নিয়ে তাঁর তৈরি কৃত্রিম জঙ্গলের পাশেই পাবেন। আর যেখানে যেটুকু পারেন চেষ্টা করেন গাছ লাগানো মানুষকে অনুপ্রাণিত করার। গাছ লাগানোর নিয়ম হল প্রাথমিক ভাবে চারা, বেড়া দেওয়ার কাঁটা এবং সারের অল্প মূল্য নেওয়া হয়। তারপর পরিচর্যার দায়িত্ব উনার। কেউ সেই মুহূর্তে পয়সা দিতে না চাইলে বা পারলে পরে গাছ বড় হলে পয়সা দিলেও চলবে। এভাবেই প্রায় হাজার খানেক গাছ লাগিয়ে ফেলেছেন উনি। প্রতিদিন সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

পাঠকদের কেউ একটা বা একাধিক চারা লাগাতে ইচ্ছুক হলে যোগাযোগ করতে পারেন স্যারের সাথে।
গৌরসাধন দাশচক্রবর্তী
কুলটিকরি
সাঁকরাইল
ঝাড়গ্রাম
মোবাইল নম্বর- ৯৭৩৩৬৩৬৭৩৬

No comments:

Post a Comment