ম্যাক্সমিলান
চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ, মানুষের সংসর্গে ছড়ায় মূলত এরকম একটা ভাইরাস ঘটিত মহামারীর আবির্ভাব । সরকারি নির্দেশ এলো বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ, সকলেই যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন । রতন ও তার চার সঙ্গী কর্মসূত্রে গিয়েছিল মহারাষ্ট্রে। ঠিকাদার বললো ওখানেই থেকে যেতে; কয়দিন পর সব মিটলে ফিরতে। তাই ওরা সেখানেই রয়ে গেলো।
তিনমাস কেটে গেলো রোগ ছড়িয়েই যাচ্ছে, প্রকোপ বাড়ছে বই কমছেনা। হাতের টাকাও ফুরিয়ে আসছে ওদের । বেশ চাপে পড়লো সকলেই । বিদেশ বিভূঁইয়ে চেনা শোনা নেই তার উপর আবার পরিস্থিতি খারাপ। অগত্যা বাড়ি ফেরার ই সিদ্ধান্ত নিল সকলে। গাড়ি ট্রেন সবই বন্ধ তাই ভগবানের নাম করে পায়ে হেঁটেই শুরু করলো যাত্রা।
রতনের বাড়িতে আছে ওর বিধবা মা, স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে। রতন যথেষ্ঠ শিক্ষিত, দর্শনে গ্র্যাজুয়েট । বাবার জমি জমা ভালোই ছিল, কিনতু চাষ করতে পারতেন না । রতনের তিন দিদি ও রয়েছে, জমি জমা বিক্রি করেই তাদের বিয়ে দিয়েছেন রতনের বাবা। বছর সাতেক আগে অসীমার সাথে রতনের বিয়ে হয়। অসিমার বয়স তখন সবে ১৭, অপটু হাতে রান্না বান্না, ঘর গোছানো করতে হতো সবই । ছোট মেয়েটাকে এতো খাটতে দেখে মাঝে মাঝে মায়া হতো, তাই ভুল করলেও কোনদিন বকাবকি করত না । রতনের মেয়ের নাম তিন্নি। ভাদ্র মাসের তিন তারিখে তিন্নির জন্ম হয়েছিল বলে ওর নাম রাখে তিন্নি। এখনো তার মনে আছে প্রথম যখন তিন্নি কে কোলে নিয়েছিল ; সেই ছোট্ট ছোট্ট হাত ; একদম জেলির মতো । কেঁদে উঠেছিল জোর করে ; ঘাবরে গিয়েছিল রতন তখন ।ওর মায়ের কোলে দিয়ে পালিয়ে আসে সেবার। তারপর কেটে গেছে বহুদিন ; তিন্নির সবে মাত্র ছয় বছর বয়স কিনতু তার কথা ষাট বছরের বুড়োদের মত। ওকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো বুড়ি তোর বাবার নাম কি?
ও উত্তর দিতো- বাবার নাম বাবা ই ।
আর মায়ের নাম জিজ্ঞেস করলেই বলতো -
জানি না ওটা আমার শত্তুর।
বাবা বাবা করেই পাগল।
গেলবছর দুর্গাপুজোয় রতন যখন শেষবার বাড়ি গিয়েছিল তখন তিন্নি কে একটা খেলনা ফোন কিনে দেয় আর তারপর থেকে অসীমা কোনোকিছুতে বকাবকি করলে ও সেই ফোন টা নিয়ে শুরু করে দেয় - হ্যালো বাবা ওই সত্তুর টা আমায় বকেছে.... পুরোটাই অসীমার মুখেই শুনেছে রতন আর খুব হেসেওছে। ফোনে প্রতিদিন রাত্রে কথা হয় অবশ্য ওদের সাথে । সেবার পুজো সেরে যখন যাওয়ার সময় হলো অসীমা তখন সাতমাসের অন্ত্বসত্ত্বা , একটুও ইচ্ছে ছিলনা রতনের কাজে যাওয়ার । অসীমা ই জোর ধরলো যেতে; বললো মা তো রয়েছে আর দরকার পড়লে দাদাকে (অসীমার দাদা) ডাকবো , আমি সামলে নিতে পারবো নাও। অগত্যা সংসারে টাকা পয়সার গুরত্ব ও তো আর কম না, কাজে না গেলে সংসার ই বা চলবে কীকরে তাই বেরিয়ে পড়লো। তিনমাস হলো রতনের একটা ছেলে হয়েছে কিনতু সব বন্ধ থাকায় ফিরতে পারেনি , তাই দেখেনি এখনো ছেলেকে । তবে ছবি দেখেছে আর নাম রেখেছে তাপস। ছেলের জন্য একটা রুপোর তাবিজ কিনে রেখেছে । আর তিন্নি বায়না ধরেছিল একটা লাল রঙের গণেশ ঠাকুর নেবে, লাল পায়নি সাদা কিনেছে একটা । দোকান পাট এমনিতেই সব বন্ধ তো তাই আর ঘাটায় নি।
বছর দুই হলো রতনের বাবা মারা গেছেন, জমাজমি তেমন কিছু রেখে যাননি, উপরন্তু দেখা গেছে জমি গুলোর অধিকাংশই বিক্রি হয়ে গেছে । তাই কাজে বেরোতে হলো রতনকে, অবশ্য নিজেরই মামাতো ভাই ঠিকাদার হওয়ায় খুব একটা অসুবিধে হয়নি কাজ পেতে । লেখাপড়া ভালোই জানে বলে ওখানে হিসেবের কাজে রেখে দিয়েছিল রতন কে, তাই ভারী ভারী জিনিস তোলা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এবার টাকাগুলো বেশি জমানো গেলো না, তবে ভালো করে বাড়ি ফিরলে বাঁচি ;এরকমই সাত পাঁচ ভাবছিল রতন । বাড়িতে অসীমা, রতনের মা সবাই খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে।একটু আগেই ফোনে কথা হলো বললো অনেকেই গ্রামে ফিরে এসে গেছে; আজ ফুচুরাও এসে গেছে; ওদের ক্লাব ঘরে থাকতে দিয়েছে; ফুচু রতনের বাল্যবন্ধু। চারদিন ধরে হাঁটছে রতনরা । পুলিশের তাড়া, লোকের বিশ্চক্ষু সবই পেতে হয়েছে ওদের । ভাগ্যিস পাওয়ার ব্যাংক টা কিনেছিল সেবার তাই ফোন টা চালু আছে এখনো । খবরে দেখলো বটে সরকার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন দেবে। কিনতু কি হয় কে জানে । রাস্তায় আসার সময় দোকান থেকে রুটি আর গুর কিনে নিয়েছিল ওরা । সেগুলোই খেয়েছে, খিদে মেটেনি যদিও তাও কি আর করা যাবে। ফোনটা একটু দেখে নিল রতন, ওয়ালপেপারে তিন্নির ছবি আছে, তিনবছরের তিন্নির গাল গুলো বেশ ফোলা ফোলা ছিল, আর সামনের দাঁত টাও ভেঙে ছিল । একটা প্রশান্তি এলো শরীর জুড়ে। সন্তান যে কতটা দামী একজন পিতার কাছে সেটাই ভাবলো রতন ।এই হাসিটার জন্যই তো এত কষ্ট দুঃখ সইতে পারছে সে। দাড়ি গুলো বেশ বড়ো বড়ো হয়েছে, তিন্নি দেখে ঘাবড়ে যাবে না তো আবার; যদি ভয় পেয়ে যায় । তাপসের জন্য তাবিজ নিয়েছি বটে কিন্ত তিন্নির জন্য তো গণেশ বাদে কিছুই নিই নি ; সেটাও আবার তার দাবি মত নয়।
বাচ্চা মেয়েটার মন টা খুন্ন হবে, বাবা কে দেখে ছুটে আসবে যে, কিনতু আমি তো ১৪দিন ছুঁতে পাবনা ওকে। যাইহোক শরীর টা ক্লান্ত অনেক; আসে পাশের সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে । রতন একাই ভাবছে এত কথা । ব্যাগ টা পায়ের পাশে রেখে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো রতন । ধুর এরকম শক্ত পাথরে ঘুম হয় নাকি, মনে হচ্ছে যেন চিতায় শুয়ে আছি ।
অদৃষ্ট হয়তো সেই কথা টা শুনতে পেয়েছিলন । লাইনের উপর শুয়েছিল সেদিন ওরা । ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সরকারি নির্দেশে তাই সকলেই নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছিল।
ধুরররররর এত আওয়াজ কিসের হচ্ছে, কে চিল্লাচ্ছে এত ভোর ভোর, চোখ খুলে তাকাতেও ইচ্ছে করলো না রতনের । শব্দটা এগিয়ে আসছে দানবের মতো কিন্তু হাত পা গুলো অবশ, চোখের পাতা টাও কথা শুনছে না ওর; কাপুনি টাও বাড়ছে শরীর জুড়ে ; বিকট শব্দ ট্রেনের হর্নের মতো। চোখ খুলে তাকালো রতন আর মাত্র সাত ফুট দূরে মৃত্যু দানব , পা টা নাড়াতে চেষ্টা করলো, পারলো না, সব শিথিল হয়ে এসেছে, একটা অসহ্য যন্ত্রণা তারপর........................................
তিনমাস পর রতনের ব্যাগ টা বাড়িতে এসে পৌঁছল ।
পুলিশ এসে দিয়ে গেল, আর কিছু আর্থিক সহয়াতার কথা আগেই জানিয়েছে প্রশাসন। ব্যাগ খুলে তিন্নি বের করলো কিছু জামা কাপড়, কাগজ পত্র, তাবিজ আর লাল রঙের গণেশ টা.......................
😢😭
ReplyDelete