বাঙালির রক্ষাকর্তা নাকি রাজনৈতিক অভিসন্ধি? - Benami Diary

Tuesday, July 14, 2020

বাঙালির রক্ষাকর্তা নাকি রাজনৈতিক অভিসন্ধি?


বাংলা আগামীদিনে মহারাষ্ট্র হতে চলেছে। হ্যাঁ রক্তক্ষয়ী মহারাষ্ট্র। এর কারণ দুটো। এক সরকারের বাংলার মানুষকে ছেড়ে অন্যান্য প্রদেশের মানুষকে তোল্লাই দেওয়া। আর দ্বিতীয় কারন প্রধান বিরোধী দলের (সে আপনি মানুন আর নাই মানুন অনারাই এখন প্রধান বিরোধী দল) অত্যধিক গো বলয় নির্ভর রাজনীতি। আর এর ফাঁক গলে বাংলার বাঙালি সেন্টিমেন্টে হাত বুলিয়ে কয়েকটি ভুঁইফোড় স্বঘোষিত বাঙালির দায়িত্ব রক্ষাকারী গোষ্ঠীর আগমন। এবং এর সাথেই একের সাথে আরেক গোষ্ঠীর পাল্লা দিয়ে অবাঙালি হেনস্থা করা। শুধু অবাঙালিই নয় বাঙালি কেউও যদি নিজেদের আত্মসমালোচনা করে  তাকেও এই সামাজিক মাধ্যমে বা তার বাইরে ওর বাড়ির কাছে গিয়ে হেনস্থা করা। এই ধরনের উগ্র রাজনীতি আমরা মহারাষ্ট্রে দেখে অভ্যস্ত। মারাঠা অস্মিতা নিয়ে সেখানে কার্যত অমারাঠি জাতি গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করা হয়। তা আজ আমাদের বাংলায়। কিন্তু এর কারণটা ঠিক কি? একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ।

 প্রথমেই আসি কেন্দ্রের সরকারের কথায়। বলে নেই কওয়া নেই হঠাৎ আসানসোল, খড়গপুর, নিউ জলপাইগুড়ির মতো স্টেশনগুলো থেকে বাংলা হটিয়ে একদম হিন্দিতে সব লেখা শুরু হল। এমনিতেই এই তালিকার দুটো শহরে বাঙালিরাই কার্যত সংখ্যালঘু এবং একরকম ইনসিকিওরটিতে ভোগে। তার ওপর এই ধরনের কাজকর্ম আরও বেশি করে তাদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও রেল ব্যাংক ইত্যাদি সংস্থায় কাজ করতে আসা বেশিরভাগ বাইরের রাজ্যের কর্মী বাংলা পড়তে পারা তো দূর অস্ত, বলতেই পারেননা ঠিক ঠাক। উল্টে সর্বদাই একরকম আমরা উচ্চশ্রেণীর মার্কা ভাব দেখানো। ফলে মানুষের ক্ষোভ প্রচন্ড বেড়ে যায় এইসব নিয়ে। আমার নিজের গ্রামে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের একাধিক কর্মচারী না ব্যাংক বোঝেন না বলতে পারেন ঠিক ঠাক। আর এই গন্ডগ্রামের অধিকাংশ মানুষের কাছে হিন্দি আর স্প্যানিশ সমতুল্য ভাষা। ফলে পরিষেবার চেয়ে হেনস্থা বেশি হতে হয় সেটা বলাই বাহুল্য। আর যারা জানেন তাদেরও নিজের রাজ্যে বসে একজন বাইরের রাজ্যের মানুষের সাথে তাঁর ভাষায় কথা বলতে হচ্ছে। অথচ আপনি মায় বিহার ঝাড়খন্ড যান, সেখানেও কিন্তু আপনাকে হিন্দিতেই কথা বলতে হয়। এখানে আবার টুরিস্ট স্পটের কথা বলবেন না যেন। ফলে বাঙালির ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হওয়া স্বাভাবিক। আবার রেলের অধিকাংশ বিজ্ঞাপন, বা তথ্য পুস্তিকা সবই হিন্দি না হয় বাংলায়। ফলে বাংলায় বসে বাংলায় পরিষেবা পাইনা আমরা

এবার ধরুন রাজ্যের কথা। রাজ্য সরকার অবাধে বিহারীদের বাংলায় আসতে এবং থাকতে দিচ্ছে। হ্যাঁ এই দেশে যে কেউ যেকোনো জায়গায় গিয়ে থাকতে বা ব্যবসা করতে পারেন। কেউ আপনাকে আটকাতে পারেনা। কিন্তু সেইসব মানুষ যখন আশেপাশের বাঙালির ওপর জুলুমবাজি করবে, তখন সেটা কে সহ্য করবে বলুন? হাওড়া স্টেশনে বা বড়বাজারে কুলিদের জুলুমবাজি, বাসে কন্ডাক্টরের জুলুমবাজি আরও কত বলব? এছাড়াও সঙ্গে বাংলায় বসে বাঙালিকে অপমান তো ফ্রিতে। এগুলো সরকার আটকাতেই পারে। কলকাতায় ফুটপাতে ব্যবসা করা প্রতি পাঁচজনে তিনজন বাংলার বাইরের মানুষ পাবেন, তাদের সরকার আটকাতে পারে? সিভিল সার্ভিসে বাঙালির চেয়ে অবাঙালির সংখ্যা বেশি। বাঙালিকে নিজের এলাকায় পরিষেবা নেওয়ার জন্য অনু ভাষায় কথা বলতে হয় তারই ট্যাক্সের তাকে বেতন পাওয়া লোকের সঙ্গে। একমাত্র বাংলাই একটি রাজ্য যেখানে বাংলা না জানলেও চাকরি পাওয়া যায়। ছট পুজোয় রবীন্দ্র সরোবর বা পাড়ার পুকুর নোংরা করার অলিখিত লাইসেন্স রয়েছে বিহারীদের কাছে। বাংলার মন্ত্রিসভায় এমন মন্ত্রীও হয়েছেন যাঁরা বাংলাটাই ঠিক করে বলতে পারেন না। এগুলো সরকার চাইলেই আটকাতে পারে। বাংলায়, নন বেঙ্গলি স্টাফের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এগুলো আটকাতেই পারে সরকার। কিন্তু না আটকানোর ফকে বাঙালির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আজ ভুঁইফোড় সংগঠনগুলির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।

তাহলে যদি বাঙালির ক্ষোভ থাকে তাহলে তো বিকল্প সংগঠন তৈরি হবেই। কিন্তু এইসব সংগঠনগুলি এক একটি আস্ত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। বাংলার বহুদিনের একটা অতিথিয়েতার ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলার মানুষ ভদ্র সভ্য শিক্ষিত এই পরিচয় রয়েছে। কিন্তু যেভাবে ধীরে ধীরে এইসব সংগঠনগুলি বাংলাকে বাঙালি বনাম অবাঙালি একটা লড়াইতে লড়িয়ে দিচ্ছে এতে সেই ঐতিহ্যের দফারফা হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় আবাঙালীদের বাঙালিদের প্রতি ভয়ানক ঘৃণা তৈরি হচ্ছে। বাংলার বাইরে প্রবাসী বাঙালিদের হেনস্থার শিকার হয়ে চলেছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়, শেষটা আরও ভয়ঙ্কর। যেটা সদ্য দেখা যাচ্ছে। কোনো বাঙালি যদি নিজেদের আত্মসমালোচনা করেও কিছু বলেন বা লেখেন, তাঁকেও ভিলেন প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। রে রে করে তেড়ে যাচ্ছেন মানুষ। এবং সামাজিকভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে। এছাড়াও শারীরিক নিগ্রহতো এরা আগেই করেছে। এরফলে শুধু অবাঙালি নয়, যদি আপনিও কোনো হক কথা বলেন, তাহলেও কিন্তু এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। এরা বাংলাকে একটা এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে যেখানে বাঙালি বনাম অবাঙালি এবং লিবারাল হয়ে যাবে। সমস্ত ইস্যু গৌণ হয়ে রাজনৈতিক লড়াই হবে বাঙালি এবং অবাঙালি। কাল হয়ত বাঙালির কোনো নোংরামির প্রতিবাদ করলেন এরা সেটা গোটা বাঙালির অপমান বলে আপনাকে শত্রু বানিয়ে দিল। এই বিষয়টা অনেকেই মনে করেন অরাজনৈতিক, কিন্তু এটি অত্যন্ত সুক্ষ রাজনৈতিক ইস্যু। অত্যন্ত সুক্ষ ভাবে একটা দল, অন্য সব দলকে গৌণ করে, নিজেদের বাঙালির মসিহা এবং সব ইস্যু গৌণ করে বাঙালি বিপদে পড়েছে এরম অবস্থা তৈরি করতে চাইছে।

হেট পলিটিক্স অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভয়ংকর। বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই রাজনীতি খুব সুন্দর করতেন। ২০০৭-১১ বাংলায় যাই ঘটুক তার জন্য দায়ী সিপিএম, এরম একটা অবস্থা তৈরি করেছিলেন। এবং সেটা এমন অবস্থায় গিয়েছি ২০১১ তে লড়াইটা সিপিএম বনাম বাংলা হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপিও খুব সুন্দর হেট পলিটিক্সের ধারক ও বাহক। দেশে সর্বদা হিন্দু খতরে মে হ্যায়, এবং ভোটের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ব্যবহার করে এক শ্রেণীর মানুষকে অন্যশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দিয়ে ভোট বৈতরণী পর করতে সিদ্ধহস্ত। অন্যদিকে প্রতিবাদ করলেই রাজ্যে মাওবাদী আর কেন্দ্রে দেশদ্রোহী। এই হল হেট পলিটিক্সের সহজ সমীকরণ। আর ব্যাংকার তথাকথিত বাঙালির মসিহারাও এই অবস্থাই সৃষ্টি করতে চলেছে, ওদের প্রতিবাদ করলেই, ওদের ভুলকে ভুল বললেই আপনি বাঙালি বিরোধী। ফলে এই মুহূর্তে নিজেদের সংযত করতে না পারলে আগামী দিনে আপনি আমিও কিন্তু হয় বাংলার বাইরে হেনস্থার শিকার হব, নয়ত বাঙলাতেই বাঙালি বিরোধী তকমা নিয়ে হেনস্থা হতে বাধ্য হব।

No comments:

Post a Comment