আমার ঠাকুমার ঝুলি - Benami Diary

Friday, July 3, 2020

আমার ঠাকুমার ঝুলি



তারে আমি চোখে দেখেনি
তার অনেক গল্প শুনেছি
গল্প শুনে
গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি


 ম্যাক্সমিলান

ছোটবেলায় যখন ঠাকুমার ঝুলি গল্প টা পড়েছিলাম তখনো দিদা আর ঠাকুমার তফাৎ টা বুঝিনি, মামাবাড়ির দিদাই ছিল দিদা ঠাকুমা সব। বাবার যখন দুবছর বয়েস তখন ধনুষ্টংকার এ আমার ঠাকুমা মারা যায়, তাই বাবার কাছেও তার কোন গল্প বা কোন স্মৃতি আমার শোনা হয়নি। আর মাথার ওপর থেকে দিদার ছায়া টাও সরে গিয়েছিল খুব কম  বয়সেই, মুখ টা স্পষ্ট মনে থাকলেও গপ্প গুলো নেই, মায়ের সাথে কথা হলে মাঝে মাঝে দিদার গল্প গুলো শুনি, সে অনেক গল্প । তবে ঠাকুমার অভাব টা সত্যিকারের বুঝেছি বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব ও তাদের ঠাকুমার কেমিস্ট্রি টা দেখার পর। ঠাকুমা সম্পর্কে যেটুকু ধ্যান ধারণা সেটা তাদের কাছেই পাওয়া আর বাকি কিছুটা কল্পনা। কারুর ঠাকুমা চঞ্চল ,কারুর রাগী ,কারুর দজ্জাল, কারুর সহজ সরল, কারুর টা একটু হাটকে মুড সুইং এর বিশুদ্ধ নিদর্শন । তবে সবার কাছেই ঠাকুমা মানে পাপ মুক্তির গঙ্গা জল, আবদারের পরম স্থল, পূর্ব জন্মের পুন্যফল। চাঁপা দেবী তথা শ্রীমতী চম্পকলি দেবী হলেন এমনই এক ঠাকুমা। তার এক নাতনি আর এক নাতি। নাতি আর নাতনি ই হলো তার ভালোবাসার কেন্দ্র বিন্দু । স্বামী প্রনবানন্দ বাবু কিছুকাল হলো গত হয়েছেন ৮২ বছর বয়েসে।জীবনের শেষ কালটায় প্রণব বাবুর মধুমেহ রোগের প্রাদূর্ভাব হয়। তবে মিষ্টির প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টির বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। একমাত্র চাঁপা দেবীর কঠোরতা ও ডান্ডা মেরে ঠান্ডার হুমকি কিছুটা কাজে লেগেছিল । তবে তেনাদের ঝগড়ার যেমন কোন অন্তই ছিলনা। অবশ্য ওটার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্বপ্নের ভালোবাসা,একে অপরের যত্ন নেওয়া, একে অপরের ভরসার কাঁধ হওয়া।  খালিপেটে গাস্ট্রো আর সকালের ইনসুলিন দেওয়া ছিল চাঁপা দেবীর প্রাথমিক কাজ । তার পর নাতি নাতনি দের স্নেহের চাদর মুড়িয়ে দেওয়ার পালা। 

স্বভাবত নাতি হয় চঞ্চল আর নাতনি স্থির, কিনতু এক্ষেত্রে ছিল উল্টো, নাতি শান্ত আর ওটি দুরন্ত। ঠিক বিভূতিভূষণ এর অপু দুর্গার মতো, দূর্গা যেরূপ বড়ো বড়ো দুটি চোখে অগাধ স্বপ্ন দেখতো আর দেখাতো এই দূর্গাও তাই,ওই দূর্গা যেরূপ পেয়ারা, আম , তুলে পালাতো এই দুর্গাও তাই । তো একবার পাশের বাড়ির এক মহিলা এসেছিলেন এই দুর্গার নামে নালিশ করতে তারপর চাঁপা দেবীর কাছে যে পরিমাণ মুখ ঝামটা খেয়েছিলেন যে আগামী শত বর্ষেও তিনি তা হয়তো ভুলতে পারবেন না। তবে ঠাকুমা যে আসলে কি দূর্গা সেটা বুঝেছিল বেশ কিছুদিন পর, দুর্গার বয়েস তখন ৯ আর অপু ৩ বছরের । বর্ষা কাল, দড়ির একটা খাটে শুয়েছিল অপু । দূর্গা খেলছিল ওর সাথে। খেলা বলতে আর কি,  বাচ্চা মেয়েরা তো ছোট বেলাতেই হয়ে ওঠে মা,সেরকমই অপুকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিল সে । রাত্রি বেলা দুর্গাকে আগেই খাইয়ে দিয়েছে, তারপর অপুর কাছে রেখে, বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেতে গিয়েছে। দূর্গা অনেকক্ষণ আদর করার পর উঠে  যাচ্ছিল এক কোনে রাখা  দিকে ট্রাঙ্ক এর দিকে , ট্রাঙ্ক এর উপর চড়ে বসতে দূর্গা খুব পছন্দ করে, ওখান থেকে বাল্বটার দিকে তাকিয়ে থাকে ও, বড়ো বড়ো দুচোখে অনেক স্বপ্ন ভরা। হটাৎ একটা জোর গোঙানির শব্দ: ''মা গো কে আছো এসো গো'' , দুর্গার মা  সবাই কে খাবার খেতে দিয়ে এসেছিল অপু দূর্গা কি করছে দেখতে । এসে দ্যাখে অপুর মাথার দিকের খাটের খুরে ফণা তুলে রয়েছে এক মস্ত কাল কেউটে  । চিৎকার শুনে তৎক্ষণাৎ সেখানে দৌড়ে আসেন তাদের ঠাকুমা । এসেই হাতে করে সাপ টাকে জানলার ওপারে ছুড়ে দেন অপুর ঠাকুমা। এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে দূর্গা তখন বাকরুদ্ধ, স্থবির। অপুর মায়ের কান্নায় আর চিৎকারে অপুর ঘুম টা ভেঙেছে তখন। চোখ রগড়ে রগড়ে উঠছে অপু। ওদিকে মা এর  কান্না থামেনি, দূর্গা  বাকরুদ্ধ, আর ঠাকুমা তথা চাঁপা দেবী অপুর পাশে শুয়ে পড়েছেন আর অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন-

"আয় আয় চাঁদ মামা
টি দিয়ে যা
মাছ ধরলে মুড়ো দেবো
ধান ভানলে কুড়ো দেবো
কালো গাইয়ের দুধ দেবো
চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যা
"


হ্যাঁ অনেক সময়ই এরকম ভাবে স্নেহের আঁচল হয়ে ওঠে লোহার বর্ম । এই ঠাকুমা এর মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে মা শব্দ টি। আগে আমার কাছে ঠাকুমা বলতে  ঠাকুমার ঝুলির সেই বুড়ি কিংবা চাঁদে চরকা কাটা বুড়ি এই দুটোই ছিল, কিনতু এখন আমি বেশ কয়েকজন ঠাকুমা পেয়ে গেছি । আমার সহপাঠী দের কৃপায় আমিও পেয়ে যাই আমার নিজের ঠাকুমা তাদের ঠাকুমার মধ্যে । তাই ভালো থেকো ,  ঠাকুমারা যে যেখানেই থেকো ভালো থেকো ।



No comments:

Post a Comment