অতীত হয়ে গেল বাংলার ব্যাঙ্কিং ইতিহাস, বাঙালির প্রতিষ্ঠান কেবলই স্মৃতি - Benami Diary

Sunday, April 5, 2020

অতীত হয়ে গেল বাংলার ব্যাঙ্কিং ইতিহাস, বাঙালির প্রতিষ্ঠান কেবলই স্মৃতি


গোটা দেশ ব্যস্ত করোনা ভাইরাস নিয়ে। আর এর মধ্যেই নিঃশব্দে ইতিহাস হয়ে গেল কলকাতার দুই ন্যাশনালাইজড ব্যাংক। ভারতের ব্যাংকিং ইতিহাসে কলকাতা একটা বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে। বলে হয় মুম্বাই নাকি ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী। আজকের বিচারে সেটা শুধু ঠিক নয়, একদমই সঠিক। তবে শুরুটা মোটেই এরম ছিলনা। ভারতের এই মুহূর্তে দ্বিতীয় বৃহত্তম ন্যাশনালাইজড ব্যাংক স্টেট ব্যাংকের জন্মও এই বাংলার মাটিতেই(ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অফ কমার্স, ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া এবং পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের সংযুক্তিতে এটিই ভারতের বৃহত্তম পাবলিক সেক্টর ব্যাংক)।হ্যাঁ, ভারতের প্রাচীনতম তথা এই উপমহাদেশের প্রথম ব্যাংক, ব্যাংক অফ ক্যালকাটার জন্ম হয় ১৮০৬ সালে এই বাংলার মাটিতেই। প্রায় তিনদশক পর ১৮৪০ সালে ব্যাংক অফ বম্বে স্থাপিত হয়। আরও তিনবছর পর দক্ষিণে জন্ম হয় ব্যাংক অফ মাদ্রাজের। ১৯২১ সালে এই তিন ব্যাংক মিলে গিয়ে হয় ইম্পেরিয়াল ইন্ডিয়া ব্যাংকের জন্ম হয়। শুধু বাণিজ্যিক পরিষেবা নয়, ১৯৩৫ সাল অবধি কার্যত রিজার্ভ ব্যাংকের দায়িত্বও পালন করেছে ভারতে। ১৯৩৫ এ রিজার্ভ ব্যাংক স্থাপিত হয় ভারতে। ১৯২১এই অবশ্য এই ব্যাংকের সদর দফতর মুম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে যাই হোক, ভারতের ব্যাংকিং পরিষেবার জন্ম এই বাংলাতেই।
কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেডের লোগো
১৯১৪ সালে কুমিল্লার ব্যবসায়ী নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, ৪০০০ টাকা পুঁজি নিয়ে কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশন তৈরি করেন। ব্যাংক তৈরির জন্য নিজের বাড়ী পর্যন্ত ১৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন তিনি। সেই কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশনই বাংলার বা বাঙালির প্রথম নিজস্ব ব্যাংক। তিনি নিজেই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে থেমে থাকেননি। তাঁর নিজের ছেলে যখন লেখাপড়া সেরে কুমিল্লা ফিরে এসে ব্যাংকে যোগদান করেন, তখন নরেন্দ্রচন্দ্রই তাঁকে একটি নিজস্ব ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৩০ সালে বটকৃষ্ণ দত্ত তিরিশ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে ১৯১৮ সালে জেসি দাস প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাংক। বাংলার এখনকার বেসরকারি ব্যাংকে বন্ধন ব্যাংকের মতন এই ব্যাংকও শুরু হয়েছিল মাইক্রো ফিন্যান্স বা লোন দেওয়া থেকেই। এছাড়াও ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক এবং ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হুগলি ব্যাংক সেসময় বাংলার ব্যাংকিং পরিষেবার তালিকায় ওপর দিকেই ছিল। ১৯৪০ সালে স্বাধীনতার ঠিক আগে নরেন্দ্রচন্দ্র দত্তকে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর দ্বারকানাথ দেশমুখ প্রস্তাব দেন তাঁর ছেলের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে নিজের ব্যাংকের সাথে মিলিয়ে নিতে। সেই বছরই দুই ব্যাংকের সংযুক্তি হয়। ঠিক চার বছর পরই এই চার ব্যাংক মিলে তৈরি হয় বাঙালির নিজের ব্যাংক ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। প্রাথমিক ভাবে কলকাতার তৎকালীন ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিটে এই ব্যাংকের সদর দফতর তৈরি হয়। পরবর্তীকালে ইউনাইটেড ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এনসি দত্তর নামে ওই রাস্তার নামকরণ করা হয়। তবে ব্যাংকের শাখার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে স্থান সংকুলান হওয়ায়, ১৯৭২ সালে ব্যাংকের সদর দফতর হেমন্ত বসু সরণিতে সরে যায়। ৩১ শে মার্চ ২০২০, অবধি সেই জায়গাতেই ছিল এই ঠিকানাতে সদর দফতর।
হেমন্ত বসু সরণিতে অবস্থিত ইউনাইটেড ব্যাংকের সদর দফতর

এতো গেল জন্মের কথা। তবে সময়ের সাথে ব্যাংক বড় হয়েছে।১৯৬৯ সালে ভারত সরকার ইউনাইটেড ব্যাংককে জাতীয়করন করে। সে সময় গোটা দেশে মাত্র ১৭৪টি শাখা ছিল ইউনাইটেড ব্যাংকের। ১৯৭৪ সালে হিন্দুস্তান মার্সেনটাইল ব্যাংক(১৯৪৪) অধিগ্রহণ করে ইউনাইটেড ব্যাংক।ঠিক দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে গুজরাটের নারং ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া মিশে যায় ইউনাইটেড ব্যাংকে। স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব ভারতে ইউনাইটেড ব্যাংক অন্যতম প্রধান সরকারি অধিগৃহিত ব্যাংক ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হত এই ব্যাংকের মাধ্যমেই। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড় গ্রামীণ ব্যাংক, বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাংকের স্পন্সর ছিল এই ইউনাইটেড ব্যাংক। এছাড়াও আসামের আসাম গ্রামীন ব্যাংক, মণিপুরের মণিপুর রুরাল ব্যাংক এবং ত্রিপুরার ত্রিপুরা গ্রামীন ব্যাংকের স্পন্সর ছিল এই ইউনাইটেড ব্যাংক। তবে সময়ের সাথে সাথে ব্যাংকের অনাদায়ী সম্পত্তি বা নন পারফর্মিং অ্যাসেটের পরিমান বেড়েছে হুহু করে। ২০১৩-১৪ সালে ব্যাংকের নন পারফর্মিং অ্যাসেটের পরিমান দাঁড়িয়েছিল এক হাজার দুশ আটত্রিশ কোটি টাকা। তখনই ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছিল।ছয় বছর পর বাঙালির গর্বের ইউনাইটেড ব্যাংক মিশে গেল পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে। আর বাঙালির গর্বের এক প্রতিষ্ঠান ঢুকে গেল ইতিহাসের পাতায়।
এলাহাবাদ ব্যাংকের বিবাদী বাগে অবস্থিত সদর দফতর

এতক্ষন কথা হচ্ছিল বাংলার ব্যাংক, বাঙালির ব্যাংকের কথা। নাহ কলকাতায় কিন্তু এর বাইরেও একটি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের প্রধান শাখা ছিল। আমি নিশ্চিত পাঠকদের বড় অংশ এতদূর পড়ে ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন। নামটা বললে বিস্ময় আরো বাড়বে। এলাহাবাদ ব্যাঙ্কেরও হেডকোয়ার্টার এই কলকাতা শহরেই ছিল গত সপ্তাহ অবধি।বিবাদী বাগের হেডকোয়ার্টারে বসে গত ৩১এ মার্চ অবধি কাজও করেছেন হাজার খানেক কর্মী। তবে ইউনাইটেড ব্যাংকের মতো এর জন্ম কিন্তু বাংলায় নয়। ২৪ শে এপ্রিল ১৮৬৫ সালে বিখ্যাত ব্যবসায়ী এবং কাশি অর্নামেন্টের মালিক বাচ্চাজির সহায়তায় একদম ইউরোপীয় ব্যবসায়ী এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক ভাবে এলাহাবাদের বাইরে ঝাঁসি, লখনৌ, বারেলি, নৈনিতাল, দিল্লি এবং কলকাতায় এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলেও স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত কলকাতা বন্দরের দৌলতে আর্থিক বৈভবে কলকাতা দিল্লির সাথে ভালোই টেক্কা দিত। আর সেই কারণেই ১৯২৩ সালে কলকাতায় এলাহাবাদ ব্যাংকের সদর দফতর স্থানান্তর করা হয়। সেসময় স্বদেশী আন্দোলনের কারনে ব্যাংকের ব্যবসাও বেশ ভালোই বেড়ে ওঠে। বাঙালি এবং মারওয়াড়ি শিল্পপতিরা বিদেশি ব্যাংকের পরিবর্তে ভারতীয় ব্যাংকে টাকা রাখা শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৬৯ সালে অন্যান্য আরও তেরটি ব্যাংকের সাথে এলাহাবাদ ব্যাংকেরও রাষ্ট্রায়াত্ত করন হয়। ১৯৮৯ সালে কলকাতার ইউনাইটেড ইনড্রাস্ট্রিয়াল ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে এলাহাবাদ ব্যাংক। তবে সময়ের সাথে সাথে ব্যাংকের আর্থিক কাঠামোতেও ঘুন ধরে। ২০১৯ সালে ভূষণ পাওয়ার এন্ড স্টিল লিমিটেডের প্রায় ১৭৭৪ কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। ওই বছরই আরো একটি জালিয়াতি সামনে আসে। পাঞ্জাবের এসইএল ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড ৬৮৮ কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। এর ফলে ব্যাংকের শেয়ার ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরই ইন্ডিয়ান ব্যাংকের সাথে সংযুক্তির ঘোষণা করে সরকার। সংযুক্তির আগে পর্যন্ত এই ব্যাংকের মত ৩৫০৩ টি শাখা ছিল।

বলা হয় বাঙালির সাথে ব্যবসার সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। এলাহাবাদ ব্যাংক ইউনাইটেড ব্যাংকের থেকে আগেই বাংলায় পদার্পন করে। তবে ব্যাংকের কাঠামোর জন্ম হয় বাংলার বাইরে। কিন্তু ইউনাইটেড ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে বাঙালির হাতে বাংলাতে তৈরি। প্রায় এক শতাব্দী গৌরবের সাথে চলার পর দুই ব্যাংকেরই সংযুক্তি ঘটল অন্য ব্যাংকের সাথে। এলাহাবাদ ব্যাংক ইন্ডিয়ান ব্যাংকের সংযুক্তির ফলে সদর দফতর হল চেন্নাইতে। অন্যদিকে ইউনাইটেড ব্যাংক পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে মিশে যাওয়াতে এবার যাবতীয় কর্মকান্ড মুম্বাইয়ের ভিকাজি কামা প্লেস থেকে পরিচালিত হবে। আর এভাবেই বাংলার দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমাপ্তি ঘটল।

তথ্যসূত্র- দুই ব্যাংকের ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া এবং ইন্টারনেটে উপলব্ধ তথ্য।

No comments:

Post a Comment