সরকারি অফিসে কোনো কাজে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়নি এমন বাঙালি বোধহয় খুব কমই আছেন। ডিএম এসডিও এনাদের দরজার বাইরে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়নি এরম মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটা ছোট্ট কাগজে তাঁদের একটা নাম স্বাক্ষর এবং তার নিচের সিলমোহর পাওয়ার পর নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। কারন ওই টুকু পাওয়ার জন্য আপনি আমি দিনের পর দিন দরজার বাইরে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু কোনোদিন ভেবে দেখেছেন আমাদের কেন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়? কোনোদিন নিজেকে অসম্মানিত মনে হয়নি? সত্যি করে বলুন মনে হয়নি? আমি বলছি না হয়নি। কারন ওনারা ব্যস্ত মানুষ, তাই আমাদের অপেক্ষা করা এবং ফিরে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কেরানির পুত্র হওয়ার কারনে সরকারি অফিসের নাড়ি নক্ষত্রটা অন্যান্য আমার বয়সী ছেলে মেয়েদের চেয়ে একটু আগেই বুঝেছি আমি।আমার মতেও একদিনে এই সরকারি কাজ হওয়ার নয় আর আমাদের ভবিতব্য এই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা। কিন্তু এর শুরুটা কোথায়?
ভারত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ। অন্তত কাগজে কলমে তাই। আর এখানে সাধারণ মানুষই কাগজে কলমে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তবুও আমরা কতটা অসহায় সেটা কোনোদিন সরকারি অফিসের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালেই বোঝা যায়। শুধু যে অফিসের বড় বাবুরা নিজেদের বড়ো মনে করেন তাই নয়, আমরা নিজেরাও মনে করি। সেই কারনেই অফিসের বাইরে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকি কৃপা দৃষ্টির আশায়। কিন্তু কাগজে কলমে এটা তো হওয়ার নয়, কিন্তু হচ্ছে। এই ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কারণটা ঠিক কি। আচ্ছা কোনোদিন ভেবে দেখেছেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলা কি? আক্ষরিক অর্থ কিন্তু দাঁড়ায় জেলা অধিকারনিক। নাহ এটা আপনি জানতেন না সেটা আমিও জানি, আর জানলে আপনি এই বাংলার হাতে গোনা কয়েকজনের একজন। ম্যাজিস্ট্রেটের একটা পাতি বাংলা হয় শাসক। সেই হিসেবে জেলা শাসক। কিন্তু এই স্বাধীন দেশে জেলার সর্বোচ্চ আধিকারিক শাসক কেন হবেন সেটা কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মানুষ থাকলে এই অধমকে একটু বুঝিয়ে দেবেন।তাও না হয় অলংকারিক অর্থে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বাংলায় জেলা শাসক হলেন। কিন্তু কোন ডিকশনারির হিসেবে একজন সাব ডিভিশনাল অফিসার বাংলায় মহকুমা শাসক হিসেবে পরিচিত হন তা আমার জ্ঞানের পরিধির বাইরে। Officer শব্দটির অর্থ আমি যতদূর জানি আধিকারিক বা উক্ত অফিসের পদাধিকারী। কিন্তু না, আমরা আজন্ম শোষিত জাতি, IAS দের শাসক না বলে যাবো কোথায়? নাম বদলে যতই সরকার ICS কে IAS করুক, পদাধিকারী ব্যক্তি যে সমান ক্ষমতার অধিকারী তা কি আর বুঝতে বাকি বাঙালির নাকি? তাই উনারা শাসক আর আমরা শাসিত। ও হ্যাঁ এই হিসেবে তো Block Development Officer সমষ্টি শাসক নামে পরিচিত হতে পারতেন, কিন্তু সম্ভবত ব্রিটিশরা এই পদ তৈরি করেননি তাই জনগনের ভাগ্য ভালো এই অফিসাররা অন্তত শাসক হতে পারেননি। সুভাষচন্দ্র যতই ম্যাজিস্ট্রেটদের ঘোল খাওয়ান আর ক্ষুদিরাম বসু, প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্যরা ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটদের মেরে স্বর্গের রাস্তা দেখান, আমরা বাঙালিরা তো তাঁদের শাসক বলেই মানব। তাহলে তাঁদের অফিসের সামনে গিয়ে ব্রিটিশ আর ভারতীয় এই দুই জাতির পার্থক্য সহ্য করবনা বললেই হল নাকি?
এতো গেল জেলা মহকুমা স্তর। এনারা শাসক আর আমরা শাসিত (পড়ুন শোষিত) তাই না হয় এঁদের অফিসে একটু ডিস্ক্রিমিনেশন সহ্য করে নিলাম। কিন্তু বাকি অফিসগুলোর সামনেও তো অবস্থাটা কমবেশি একই থাকে। সেটা কেন হয়? সেটারও একটা ব্যাখ্যা দেব, ধৈর্য ধরুন। কোনোদিন ওই অফিস গুলোতে অফিসের পিয়ন বা ক্লার্করা ওই অফিসের পদাধিকারীদের কি নামে ডাকেন সেটা শুনেছেন? হ্যাঁ উনারা ওই পদাধিকারীদের সাহেব বলেই ডাকেন। আর এই সংস্কৃতিও ব্রিটিশদেরই দান। ব্রিটিশ আমলে ওই বড় পদে ব্রিটিশ বসতেন এবং তাদের সাহেব বলে অভিহিত করা হত, তাই স্বাধীনতার এতো বছর পর একজন নেটিভ ওই পদে বসলেও তাঁদের আমরা সাহেব বলেই ডাকব। কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের। দুইশত বছরের পরাধীনতায় আমাদের আমাদের রক্তে এই বিষয়গুলো এমনভাবে ঢুকে গেছে যে উঁচু পদে বসা মানুষ মানেই আমাদের কাছে সাহেব। এবং সেই সংস্কৃতি মেনেই আমরা তাঁদের কাছে সেই ব্যবহারটাই পাই যেটা সাহেবরা আমাদের সাথে করতেন। এমন বহু পদ যা স্বাধীনতার পর সৃষ্টি হয়েছে সেঈশ্ব পদাধীকারীও সাহেব নামে অভিহিত হন। সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সেটা অতি কম।
এ তো নাহয় সাহেব শাসক গেল। কিন্তু আমরা আমাদের পরিবর্তন করতে পেরেছি, যে ওই চেয়ারে বসা লোকগুলো করবে? এখনো একজন জনপ্রতিনিধিকে আমরা স্যার বলে ডাক। কেন ডাকব? তিনি আমার প্রতিনিধি, প্রয়োজনে তিনি আমাকে স্যার বলবেন। কিন্তু না, আমরা বলি। আজও কোনো উচ্চপদে একজন আদিবাসী অফিসারকে দেখলে আমাদের চোখ টেরা হয়ে যায়। বিশেষ করে আদিবাসী অফিসার বা কর্মীদের পদবী ধরে ডাকাটা প্রায় নিয়মের মতো। এবং একজন আদিবাসী সে যত বড়ই হোক আমি বাঙালি কোনোদিন তাঁকে কোটার মাল ছাড়া কিস্যু বলতে পারেনি। আবার হয়ত কোনো মহিলা ওই উঁচু পদে রয়েছেন তখন আমরা সাহেবের পরিবর্তে ম্যাডাম বলি। কিন্তু আমি কোনো সাধারণ মানুষকে কোনো উচ্চপদে আসীন মহিলাকে ম্যাডাম স্যার বলে সম্ভাষণ করতে শুনিনি। এখানেও সেই মহিলাকে বারেবারে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে যিনি যত বড়ো পদেই যান, তিনি মহিলাই।
দুশ বছরের ব্রিটিশ শাসন কিছু দিক বা না দিক আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বশ্যতার বীজ বপন করে দিয়ে গেছে। অতি অশিক্ষিত মানুষও Yes Sir, No Sir, Sorry Sir এই তিনটি শব্দবন্ধ আওড়াতে পারেন। আর সেই সুবাদেই আমরাও আমাদের মননে সেই পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থেকেই এই সব অফিসারদের সাহেব ভেবে চলি।গোটা বাংলায় আপনি স্বাধীন ভারতীয় হলেও কোনো পুরোনো সরকারি অফিসে গেলেই সেই পরাধীন ভারতের স্বাদ পাবেন। ব্রিটিশ আর্কিটেকচার আর ব্রিটিশ ব্যবহার। দরজার বাইরে বসে ভারতীয় পিয়ন যে আরেক ভারতীয়র সামনে নিজেকে বিশাল বড় ভাবে, কারন সে সকল বিকেল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে চা জল দেয়। ব্রিটিশ তো কবেই ভারত ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু আমরা আমাদের মননে সেই ব্রিটিশ সাহেবদের রেখে দিয়েছি। অফিসের সামনে যতই ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে ভারতীয় পতাকা উড়ুক, ঘরের ভেতর কিন্তু সাহেব বসে।
প্রসঙ্গত- বাংলার বাইরে বহু রাজ্যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সমতুল্য পদাধিকারীরা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর বা ডেপুটি কমিশনার নামে পরিচিত।যার বাংলা করলে দাঁড়ায় জেলা সমাহর্তা বা উপাধ্যক্ষ।